এক দিনে ভ্রমণ করুন খাগড়াছড়ি - সাইফ ব্লগ

Latest

Thursday, August 30, 2018

এক দিনে ভ্রমণ করুন খাগড়াছড়ি


উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে ফেণী নদী ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য জেলাকে ঘিরে রেখেছে। এখানে রয়েছে আকাশ-পাহাড়ের মিতালী, চেঙ্গী ও মাইনী উপত্যকার বিস্তীর্ণ সমতল ভূ-ভাগ ও উপজাতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যতা।



খাগড়াছড়ি জেলাকে বাংলার দার্জেলিং বলা হয়ে থাকে ।  খাগড়াছড়ি একটি নদীর নাম। নদীর পাড়ে খাগড়া বন থাকায় পরবর্তী কালে তা পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে উঠে, ফলে তখন থেকেই এটি খাগড়াছড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।
ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম থেকে খুব ভোরে  খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। ফেনী থেকে শান্তি পরিবহনে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায় ।যাওয়ার পথে মাটিরাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত রিসাং ঝর্ণায় নেমে ঝর্ণায় পানিতে গোসল করে আলু টিলা তারেং যেতে পারেন  ঘুরে যেতে পারেন ।  

  ছবি-রিসাং ঝর্ণা 


 রিসাং ঝর্ণার শীতকালের দৃশ্য। বর্ষাকালে গেলে ঝর্ণার পূর্ণ যৌবন দেখা যাবে। 
১০০০ফুট উঁচু খাগড়াছড়ির আলুটিলা নামক পাহাড়ের উপর “তারেং” যেখান থেকে আপনি পুরো খাগড়াছড়ি শহরটাকে দেখতে পারেন পাখির চোখে। এ জায়গায় দাঁড়িয়ে দিগন্তে তাকালে মনে হবে যেন আকাশ পাহাড়ের গায়ে মিশে গেছে। উঁচু নিচু ঢেউ তোলা পাহাড় দূর দৃষ্টির সমতলে সর্পিল বয়ে চলা চেঙ্গী নদী নিমেষেই আপনার মন জুড়িয়ে দিবে। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তারেং’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘উঁচু পাহাড়’। তারেং পর্যটনকেন্দ্রের আশপাশে চোখে পড়বে অসংখ্য জুমখেত। আনারস, কমলা ও সবজির বাগান। জুমখেত আর গভীর অরণ্যে ঘেরা পাহাড়ি গ্রাম অন্য এক জগতে নিয়ে যাবে পর্যটকদের। অবিরাম ঝিঁঝি পোকার ডাক, নানা জাতের পাখির কলরব আর পাতার মর্মরধ্বনি।খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে রিসাং ঝর্ণা থেকে আলু টিলা তারেং যেতে পারেন ।




ছবি - আলুটিলা তারেং থেকে খাগড়াছড়ি শহরের দৃশ্য 
ছবি - আলুটিলা তারেং

 

 আলুটিলা তারেং পর্যবেক্ষন করার পর নেমে যেতে পারেন আলু টিলা রহস্যময় সুড়ঙ্গে ।গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে অন্ধকার পাতালে নেমে যাওয়া কল্পনার বিষয় হলেও আলুটিলার সুড়ঙ্গ পথ কল্পনার কিছু নয়। আলুটিলা কেন্দ্রের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এর ‘রহস্যময় সুড়ঙ্গ’। স্থানীয় লোকের ভাষায় ‘‘মাতাই হাকর’’ যার বাংলা অর্থ দেবগুহা। এ পাহাড়ের চূড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ির নীচে আলুটিলা পাহাড়ের পাদদেশে পাথর আর শিলা মাটির ভাঁজে গড়া এ রহস্যময় সুড়ঙ্গের অবস্থান। গুহামুখের ব্যাস প্রায় ১৮ফুট আর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮০ফুট। প্রবেশমুখ ও শেষের অংশ আলো-আঁধারিতে আচ্ছন্ন। মাঝখানে নিকষ কালো গাঢ় অন্ধকার এ গুহার তলদেশ দিয়ে প্রবাহমান শীতল জলের ঝর্ণাধারা। গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে এ গুহায় প্রবেশ করাটা একদিকে যেমন ভয়সংকুল তেমনি রোমাঞ্চকরও বটে। শুধু বাংলাদেশেতো বটেই পৃথিরীর অন্য কোন দেশেও এ রকম প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ পথের খুব একটা নজীর নেই। অনন্য সাধারণ এ গুহায় মশাল বা উজ্জ্বল টর্চের আলো ব্যতীত প্রবেশ করা যায় না। মশাল পর্যটন কেন্দ্রেই পাওয়া যায় ১০টাকার বিনিময়ে। গুহার একদিকে ঢুকে অন্যদিকে গিয়ে বেরোতে সময় লাগে মাত্র ১৫/২০মিনিট। উপমহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক এ সুড়ঙ্গ জেলার প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।

 ছবি -আলু টিলা সুড়ঙ্গের মুখে


             ছবি -আলু টিলা সুড়ঙ্গ


 ছবি -আলু টিলা সুড়ঙ্গ


 আলুটিলা সুড়ঙ্গ পর্যবেক্ষন শেষে আলু টিলা পর্যটন কেন্দ্রের পাশে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহার পরিদর্শন করতে পারেন 


ছবি- বৌদ্ধ বিহার  

তৈদুছড়া
বৌদ্ধা বিহার পরিদর্শন শেষে আবার বাসে বা সিএনজি চালিত গাড়িতে দিঘীনালায় অবস্থিত তৈদুছড়া ঝর্ণা দেখতে পারেন । খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ঝর্না দুটির নাম তৈদুছড়া ঝর্না। ত্রিপুরা ভাষায় “তৈদু” মানে হল “পানির দরজা” আর ছড়া মানে ঝর্না। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা এই ঝর্নাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। খাগড়াছড়িতে যে কয়টি দর্শনীয় স্থান রয়েছে তৈদুছড়া তাদের মধ্যে অন্যতম। এখানে পাহাড় আর সবুজ বুনো জঙ্গেলর মাঝে আঁকা বাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে বয়ে চলে ঝর্নার জল। ৩০০ ফুট উচু পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়া পানি এসে পরছে পাথুরে ভূমিতে। অন্য সকল ঝর্নার মত এর পানি সরাসরি উপর হতে নিচে পরছে না। পাহাড়ের গায়ে সিড়ির মত তৈরি হওয়া পাথুরে ধাপ গুলো অতিক্রম করে নিচে পরছে।

  ছবি- তৈদুছড়া ঝর্ণা


সব স্থান পরিদর্শন শেষে গাড়িতে খাগড়াছড়ি শহরে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে শহরে অবস্থিত জেলা পরিষদ পার্কে ঘুরতে যেতে পারেন ।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে জিরোমাইল এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত নয়নাভিরাম খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্ক।

দু’টি পাহাড়কে একটি ঝুলন্ত ব্রিজের মাধ্যমে সংযুক্ত করে ২২ একর জায়গা জুড়ে ২০১১ সালে এ পার্কটি স্থাপিত হয়েছে। পার্কটির পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে হ্রদ। সেখানে নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা।
এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অত্যন্ত মনোরম। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছগাছালি ছাড়াও জেলা পরিষদের উদ্যোগে পরিকল্পিতভাবে এখানে বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ লাগানো হয়েছে।এ পার্কে দেখতে পাবেন প্রচুর আম, শুপারি, নারকেল, কাঁঠাল, পেয়ারা, লেবু, জাম্বুরা, জলপাই, কামরাঙ্গাসহ বিভিন্ন প্রকার ফলদ গাছ। পার্কটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ঝুলন্ত ব্রিজ। ৪ ফুট চওড়া ও প্রায় ২৫০ ফুট লম্বা ব্রিজটিতে রয়েছে নাইলনের নেটের রেলিং। ফলে চলাচলের সময় ব্রিজটি ঝুললেও পর্যটকদের পড়ে যাওয়ার ভয় নেই।

শহরের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। প্রায়শ পার্কটিতে বিভিন্ন নাটক ও শর্ট ফিল্মের শুটিং হয়।
ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে দ্বিতীয় পাহাড়ে গেলে সেখানে রয়েছে একটি কিডস কর্নার ও একটি ট্রেন। এ দুটি উদ্বোধন করা হলেও কিডস কর্নার ও ট্রেনের আশেপাশের উন্নয়ন কাজ চলছে। শিগগিরই জনসাধারণের জন্য এ দু’টি উন্মুক্ত করা হবে।
 

 ছবি - জেলা পরিষদ পার্কে অবস্থিত ঝুলন্ত ব্রীজ   



জেলা পরিষদ পার্ক থেকে ঘুরে যেতে পারেন হেরিটেজ পার্কে । আনসার বিডিপির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশেই এর অবস্থান।সব তত্ত্বাবধানও তাদের। ২০১২ সালে নির্মিত পার্কটিতে পাহাড়ের প্রকৃতি অক্ষত রেখে সেখানে কিছু নান্দনিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ছোট একটি পাহাড়ে চেঙ্গী নদীর ঝিরি ঝিরি মৃদু ঠান্ডা বাতাসে সময় জুড়ি নেই হেরিটেজ পার্কের।

চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি রোডের কোলঘেঁষে ঠিক পর্যটন মোটেলের অপরপাশে যে সড়কটি উপরে উঠেছে সেটিই হেরিটেজ পার্কের মূল রাস্তা। পার্কে যখনই প্রবেশ করুন না কেন আঁকা-বাঁকা সর্পিল রাস্তার পাশে বাঁশ-বেত-ছনের তৈরি বিশেষ নান্দনিক স্থাপনা অভ্যর্থনা জানাবে সাদরে। রাতে এর ভেতরে আলো জ্বলে। পাশেরই সবুজ ঘাষ, বিভিন্ন ধরনের পাতা বাহার, টগর, রঙ্গন, বাগানবিলাস, জবা সঙ্গ দেয় সে আলোকে। আর দিনের আলো আরও আলোকিত হয় এসব ফুলেররূপ-গন্ধে।পার্কটির বিশেষ কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। পাহাড়ের মধ্যেই আবার রয়েছে চড়াই-উৎরাই। বাংলাদেশ যেহেতু ব-দ্বীপ সেহেতু পাহাড়ের ঠিক নিচে পার্কের ভেতরে মাটি কেটে তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র। চারপাশে তার পানি। জেলাগুলো সাদা রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একরাশ সবুজে সাদা ব্যাঙের ছাতা!এখানে রয়েছে একটি খাবারের দোকান। ফাস্টফুড ছাড়া অন্য খাবার খেতে হলে অর্ডার করতে হয় আগে। তবে বিকেলটা জমে বেশি। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পাহাড়ি প্রাকৃতিক পরিবেশে চেঙ্গী নদীর বাতাস, প্রকৃতি আর পাখির গান শুনতে শুনতে সময় হারিয়ে যায় সময়ের গহীনে। বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জমজমাট থাকে এ পার্কটি।

হেরিটেজ পার্কের তত্ত্বাবধায়ক ও জেলা আনসার বিডিবির কমান্ড্যান্ট রাজীব হোসেন  বলেন, আগে ১০ টাকা টিকিট থাকলেও এখন ফ্রি। কেউ চাইলে পিকনিকের জন্য আগে থেকে বুকিং দিতে পারে। খরচ দিতে হবে জনপ্রতি ২০ টাকা। পড়ে থাকা সাধারণ জায়গায় ঐতিহ্যের বাংলাদেশকে তুলে ধরার সামান্য প্রয়াস এ পার্ক।



ছবি- হেরিটেজ পার্ক 


বিকাল পাঁচটায়  গাড়িতে আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠতে পারবেন । 

লেখক- মো সাইফুল ইসলাম , এমএসসি (গণিত)
সহকারি শিক্ষক (গণিত)
অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়।




No comments:

Post a Comment